চিকিৎসা পরিষেবার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন রোগী(চিত্র ১)। এই প্রবন্ধটিতে আমরা রোগীর পরিপ্রেক্ষিত থেকে চিকিৎসার মান নির্ণয় করবার চেষ্টা করব, রোগীদের কথা ভাবব। আমরা সকলেই রোগী, জীবনের কোন না কোন সময়ে। রোগী আছেন বলেই না চিকিৎসক আছেন, চিকিৎসা-ব্যবস্থাটি আছে। এখানে চিকিৎসক অর্থে সবাইকে বোঝান হয়েছে, যাঁরা চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করছেন তাঁরা সবাই এর আওতায় পড়বেন, এঁরা চিকিৎসা নামক সেবাটির পরিষেবক। এঁদের মধ্যে ডাক্তার যেমন আছেন, তেমন আছেন নার্স , ফিজিওথেরাপিস্ট, প্রমুখ সকলে যাঁরা কোন না কোন ভাবে আমাদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করেন।
চিকিৎসা পরিষেবায় রুগী ও ডাক্তারবাবুর অবস্থান গ্রহীতা ও দাতার ভূমিকায়। রুগী গ্রহীতা, ডাক্তার দাতা। একজন চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করবেন (ডাক্তার/চিকিৎসা-প্রদানকারী), অন্যজন তাকে গ্রহণ করবেন (রোগী)। এঁদের বৃত্তের বাইরে আছেন যাঁরা স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিষেবাকে অর্থ ও অন্যান্য সামগ্রীর যোগান দিয়ে চালু রাখেন। এঁদের মধ্যে ভারতে সরকারের ভূমিকাই সবচেয়ে আগে বিবেচনা করতে হবে, কারণ সমাজব্যবস্থায় সরকার দেশের চিকিৎসা পরিষেবার বেশ বড় একটা অংশ সরকারী অনুদান ও সরকারের বাজেট থেকে স্বাস্থ্যের খাতে সরিয়ে রাখা অর্থের যোগানের ওপর নির্ভরশীল। জাতীয় সরকার ও রাজ্য সরকার আমাদের দেশে সরকারী চিকিৎসালয়ের যাবতীয় দায়ভার বহন করেন। এছাড়াও সরকারী-বেসরকারী পার্টনারশিপে যে সমস্ত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান চলে তাদের ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্য দপ্তরের অবদান রয়েছে। ভারতে রেল ও সামরিক প্রতিষ্ঠানের হাসপাতালে যে চিকিৎসা হয় তার খরচও সরকারের। বেসরকারী ক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচ যোগান হয় রুগী বা তাঁর পরিবাররা, তা না হলে যাঁদের বীমা করা আছে, সেক্ষেত্রে বীমা কোম্পানীগুলো। ভারতে অবশ্য সাধারণ মানুষের পকেট থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবার বেশ বড় অংশ খরচা হয় \cite{dieleman2017future}।
স্বাস্থ্য-চিকিৎসা-পরিষেবার মান ও উৎকর্ষতা নিয়ে এই তিন শরিকের আগ্রহ একেক রকম। রোগী বা তাঁর বাড়ির লোকের ক্ষেত্রে রোগমুক্তি বা রোগের উপশম বড় কথা, যত কম সময়ে যত দ্রুত সু্স্থ হয়ে ওঠা যায়, যত কম অন্যান্য শারীরিক অসুবিধে হয়, আমরা রোগীরা সেটাই চাই। তাই রুগীর বা তাঁর বাড়ির লোকের পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসার মান নির্ধারণ করতে হবে রোগ নিরাময় ও তৎসংলগ্ন পরিষেবাকে কেন্দ্র করে। এর মধ্যে আবার রোগী নিজে যখন অর্থদাতা, তখন তাঁর একরকম অবস্থান, আর যখন তাঁকে নিজেকে চিকিৎসার অর্থব্যয় বহন করতে হচ্ছে না তখন তাঁর অন্য রকম অবস্থান। যে দেশে সরকার বা সমাজ বা বীমা কোম্পানী চিকিৎসার খরচ দেন, তখন রোগীর তরফ থেকে কতটা খরচ হল, অত ভাবি না আমরা রোগীরা। আবার যখন বেসরকারী চিকিৎসা পরিষেবার গুণমান নির্ণয় করতে হবে, রুগীর পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষ করে যাঁরা নিজের চিকিৎসার ব্যয়ভার নিজেরা বহন করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে শুধু রোগমুক্তি বা ভাল হয়ে ওঠা দেখলে চলবে না, কত কম সময় ও কত কম অর্থ ব্যয় হয়, সেটিও বিচার করে দেখতে হবে। যত কম খরচায়, যত কম সময় ব্যয় করে যত ভাল পরিষেবা পাওয়া যায়, তত মঙ্গল, তাই চিকিৎসার ফলাফলের দিকে রুগীর নজর প্রথমে, তার পরে চিকিৎসার ব্যয়সংক্রান্ত বিষয়গুলি বিচার্য।
চিকিৎসকের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে দেখবেন চিকিৎসা পরিষেবার মান নির্ধারিত হবে কত দ্রুত রুগী ভাল হয়ে গেলেন, বা কতটা সাক্ষ্যভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করে চিকিৎসা করা হয়েছে । সেখানে কতটা সাশ্রয়ী চিকিৎসা হল, সেটা সবসময়ে বড় কথা নাও হতে পারে । বহু চিকিৎসকের কাছে, চিকিৎসার ব্যয়বাহুল্য বা রুগীর ইচ্ছে অনিচ্ছে অনুযায়ী চিকিৎসার রদবদল করার থেকেও রুগীর আরোগ্যলাভ করাটা বিশেষ করে উপসর্গের উপশম হওয়ার একটি আশু প্রয়োজন থাকে; তাই চিকিৎসকের পরিপ্রক্ষিতে চিকিৎসার মান নির্ধারণ কিছুটা রোগীর মতন হবে কত দ্রুত রুগী সুস্থ হয়ে উঠলেন, তবে কতটা কম অর্থব্যয় করে তাঁর চিকিৎসা করা গেল, অন্তত চিকিৎসা পরিষেবার মান নিরূপণে তা ততটা বিচার্য নাও হতে পারে।
বাকী রইল যাঁরা চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করছেন বা চিকিৎসার খরচা বহন করছেন তাঁদের পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসা-পরিষেবার মান কি হবে? তাঁরা অবশ্যই বিচার করবেন যে সেই চিকিৎসাই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের যাতে কম খরচায় মানুষ দ্রুত সুস্থ হতে পারে। এখানে সময় ও অর্থ -- দুভাবেই কত কম খরচায় "কতটা স্বাস্থ্য পাওয়া" যায় সেই ব্যাপারটি বিবেচ্য।